ভারতীয় সভ্যতার আদি কালে, আদিভাষা দেবভাষাতেই সমস্ত রকম শ্লোক ও বিভিন্ন আখ্যান রচিত হত। সময়ের বিবর্তনে কালক্রমে ভাঙাচোরা সংস্কৃত ও কিছু কিছু আঞ্চলিক ভাষা থেকে রসদ নিয়ে ধীরে ধীরে অঙ্কুরিত হয় বাংলা ভাষা। বাংলা ভাষা সৃষ্টির বহু বহু কাল পরে মোটামুটি ভাবে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও সমকালীন কিছু সাহিত্যিকের হাত ধরে আধুনিক বাংলা ভাষার সূত্রপাত।
গল্প উপন্যাস ভিত্তিক বাংলা সাহিত্যচর্চার গোড়াতে পুরুষদেরই একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। সেখানে মহিলা সাহিত্যিকের উপস্থিতি অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েই দেখতে হত। উনিশ শতকের শেষ দিকে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল থেকেই প্রথম উঁকি দিতে দেখা যায় বাংলা সাহিত্যের আঙিনায় মহিলা-মুখ। তিনি হলেন ঠাকুর বাড়ির স্বর্ণকুমারী দেবী। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক ও সমাজসেবী। জন্ম ২৮ আগস্ট, ১৮৫৫। স্বর্ণকুমারী দেবী ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের পৌত্রী। দ্বারকানাথ-পুত্র মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সারদা দেবীর দশম সন্তান এবং চতুর্থ কন্যা স্বর্ণকুমারী। তাঁর বড় তিন দিদি— সৌদামিনী, সুকুমারী ও শরৎকুমারী এবং তাঁর ছোটবোন বর্ণকুমারী। রবীন্দ্রনাথের চেয়ে স্বর্ণকুমারী পাঁচ বছরের বড়। এই স্বর্ণকুমারী দেবীর ৭৭ বছরের দীর্ঘ, কর্মবহুল এবং বর্ণময় জীবনের অন্তে তাঁর জীবনদীপের অবসান হয় ১৯৩২ সালের ৩রা জুলাই।
ঠাকুরবাড়ির প্রথা মেনে বাড়িতেই তাঁর পড়াশোনার হাতেখড়ি। প্রথমে এক শিক্ষয়িত্রী ও পরে অযোধ্যানাথ পাকড়াশির কাছে। তারপর দিদিদের মতো তিনিও গেলেন বেথুন সাহেবের স্কুলে। স্বর্ণকুমারীর বিয়ে হয় ধুমধাম করে, নদীয়া জেলার সুশিক্ষিত এক জমিদার তনয় জানকীনাথ ঘোষালের সঙ্গে, যিনি পারিবারিক আশ্রয়চ্যুত হয়েও নিজেই নিজের চেষ্টায় এক বিরাট আর্থিক সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হয়ে উঠেছিলেন। আর সেই সূত্রেই তাঁর নামের আগে ‘রাজা’ উপাধিটি জুড়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা তথা আদি যুগের সক্রিয় কংগ্রেস সদস্য হিসেবে দেশের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে তাঁর অগ্রণী ভূমিকা ছিল। মননের দিক থেকেও তিনি ছিলেন উদার প্রকৃতির। বাঙালি নারীকে ঘরবন্দী করে রাখার পক্ষপাতী তিনি ছিলেন না। আর তাই প্রগতিশীল জানকীনাথ নিজের স্ত্রী-কন্যাদের কখনোই অন্দরমহলে বন্দি করে রাখেননি। শিক্ষাসংস্কৃতিসাহিত্যের আঙিনায় নিজের ঘরের মেয়েদের প্রতি তিনি ছিলেন অত্যন্ত সহনশীল স্বামী ও পিতা। সব সময়েই বাইরের জগতে তিনি তাঁদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন।
স্বর্ণকুমারী দেবী সাহিত্য কর্মে নিজের প্রতিভা উজাড় করে দিয়ে যেসব ফসল ফলিয়ে ছিলেন তার মধ্যে একটি কাহিনি নিয়ে ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’। জাতীয়তাবাদী ভাবনায় অনুপ্রাণিত এই লেখাটিই বাংলা সাহিত্যে কোনো বাঙালি নারী রচিত প্রথম সার্থক উপন্যাস।
ঠাকুরবাড়ির আর এক গুণী মহিলা ছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্মৃতিচারণে জানা যায়, জানকীনাথ ইংল্যান্ডে গেলে স্বর্ণকুমারী দেবী জোড়াসাঁকোয় চলে আসেন। জ্ঞানদানন্দিনী দেবী তখন মহা উৎসাহে প্রাচীন পারিবারিক প্রথাগুলোর সংস্কার করে নারী স্বাধীনতার পথ তৈরি করছিলেন। স্বর্ণকুমারী দেবী তাঁর সঙ্গে একাধারে সেকাজে হাত লাগালেন,আর অন্য দিকে সাহিত্য সৃজনেও নিজেকে একাগ্র ভাবে সঁপে দিলেন।
জানকীনাথ ও স্বর্ণকুমারী দেবীর তিন সন্তান। এঁরা হলেন পুত্র জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল এবং দুই কন্যা হিরণ্ময়ী দেবী ও সরলা দেবী চৌধুরাণী। তিনজনেই স্ব স্ব মহিমায় সমুজ্জ্বল। হিরণ্ময়ী দেবীর নাম একজন সমাজসেবী হিসাবে সেই সময় সকলের কাছে অত্যন্ত পরিচিত হয়ে ওঠে। আর সরলা দেবী জীবনের সমস্ত দিগন্ত আলোকিত করে মহাত্মা গান্ধীর বিশেষ কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন। পুত্র জ্যোৎস্নানাথ পারিবারিক কৃতীর পরিমণ্ডলে অপেক্ষাকৃত কম আলোকিত ছিলেন। তিনি তখনকার দিনে আর পাঁচটি উচ্চবিত্তের পরিবারের পুত্র সন্তানদের মতোই প্রথাগতভাবে নিশ্চিন্ত ভবিষ্যৎ জীবনমুখী ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। আইসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বাংলার বাইরে সরকারি প্রশাসনের একজন আমলা হয়েই জীবন কাটান।
স্বর্ণকুমারী দেবী সাহিত্য কর্মে নিজের প্রতিভা উজাড় করে দিয়ে যেসব ফসল ফলিয়ে ছিলেন তার মধ্যে একটি কাহিনি নিয়ে ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দীপনির্বাণ’। জাতীয়তাবাদী ভাবনায় অনুপ্রাণিত এই লেখাটিই বাংলা সাহিত্যে কোনো বাঙালি নারী রচিত প্রথম সার্থক উপন্যাস। এরপর ১৮৭৯-তে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম অপেরাধর্মী বাংলা গীতিনাট্য ‘বসন্ত উৎসব’। বিস্ময়ের কথা, বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা ‘পৃথিবী’ও তাঁর কলম থেকেই বেরিয়েছে। কোনো বাঙালি লেখিকার এই ধরনের বিষয় নিয়ে সৃষ্ট সাহিত্যও এই প্রথম। তাঁর আরও কয়েকটি উপন্যাস, ‘মেবার রাজ’, ‘ছিন্ন মুকুল’, ‘বিদ্রোহ’, ‘কাহাকে?’, ‘মিলনরাতি’ বাঙালি সাহিত্য রসিকদের জন্য তিনি উপহার দিয়ছিলেন। কবিতার জগতেও ছিল তাঁর সাবলীল সন্তরণ। কাব্যগ্রন্থ হিসাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘গাথা’ ও ‘গীতিগুচ্ছ’। মোট ১৩টি উপন্যাস, ৮টি নাটক, ২টি কাব্যগ্ৰন্থ-সহ অন্যান্য লেখায় সাজানো ছিল তাঁর সাহিত্যের সম্ভার।
তবে হ্যা, তাঁর সব লেখাই যে উৎকৃষ্ট বা কালোত্তীর্ণ হয়েছিল তা নয়। কিন্তু সেই সময়ের সামাজিক বন্ধন আবদ্ধ সমাজ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর চিন্তার প্রসারতা, সাহসী অগ্ৰগামীতা ও সাহিত্যিক সৃজনশীলতার সাক্ষ্য ছিল তাঁর প্রায় প্রতিটি সাহিত্য সৃষ্টির মধ্যে।
পরবর্তীতে স্বর্ণকুমারী দেবীকে ‘ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দেখা যায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবর্তিত পত্রিকাটির প্রথম সাত বছর সম্পাদক ছিলেন বড় দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ। এরপর তিন দফায়, মোট উনিশ বছর ‘ভারতী’র সম্পাদকীয় দপ্তরের হাল ধরেছেন স্বর্ণকুমারী দেবী। এই সময়েই বাংলা সাহিত্যে ‘ভারতী’ তার নিজস্ব পরিচয় গড়ে তোলে। পাঠকের রুচি ও লেখকের রচনার উৎকর্ষ নির্মাণে স্বর্ণকুমারীর ‘ভারতী’ স্বর্ণাক্ষরে স্মরণীয় হয়ে আছে। সহজ সরল ভাষায় মৌলিক রচনায় ঠাসা ‘ভারতী’ রবীন্দ্রনাথের হাত থেকেও কলম নামাতে দেয়নি। ‘ভারতী’র যাত্রা শুরুর সময়ে রবীন্দ্রনাথের বয়স ছিল ষোলো। তাঁর অসংখ্য রচনা ‘ভারতী’কে পুষ্ট করেছে। ‘ভারতী’র সামগ্ৰিক উপহার ও অবদান বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তার সৌষ্ঠব ও সমাদর বাড়িয়েছে, একথা অস্বীকার করার নয় এবং এই কৃতিত্বের অনেকটাই সম্ভব হয়েছে স্বর্ণকুমারীর পত্রিকা সম্পাদনার গুণে।
স্বর্ণকুমারী দেবী জীবনটাকে শুধু জড়িয়ে রাখেননি সংসার, সন্তান পালন আর সূচীকর্মের সীমানায়। নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন সাহিত্যে, সমাজ সংস্কার ও সেবা এবং রাজনীতিতেও। এর জন্যে তাই আবারও উল্লেখ করতে হয় তাঁর স্বামীর সহাস্য সোৎসাহ সমর্থন। সমাজ বন্ধনের ফাঁসে এই কাজের জন্য তাঁকে বিদ্রোহিনী হতে হয়নি। তার ফলে এবং নিজের প্রতিভাতেই পল্লবিত ও প্রতিভাত হয়েছেন তিনি।
সমাজসেবার কাজেও তাঁর ছিল ব্যতিক্রমী ভূমিকা। সমাজ-সংসারে অসহায় অনাথ ও পরিত্যক্ত বিধবাদের করুণ অবস্থা মোচনে এগিয়ে এসেছিলেন স্বর্ণকুমারী। তাঁদের জন্যেই গড়ে তুলেছিলেন ‘সখী সমিতি’। সমিতির নামকরণ করে দেন তাঁর আদরের ছোটো ভাই ‘রবি’। এঁদের ভরণপোষণ-সহ লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়ে ধীরে ধীরে তাঁদের স্বনির্ভর করে তোলা ছিল তাঁর উদ্দেশ্য, যাতে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে তাঁরা সসম্মানে বাঁচতে পারেন। খালি চাঁদার ওপর ভর করে এত বড় একটি কর্মকাণ্ড না চালিয়ে লৌকিক মেলা সংগঠিত করে ‘সখী সমিতি’কে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। দিদির পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণে অর্থের জোগান দিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘মায়ার খেলা’ মঞ্চস্থ করেছিলেন।
১৯০৬-এর পর স্বর্ণকুমারীর কন্যা হিরন্ময়ী দেবী এই বিধবা আশ্রমের দায়িত্ব নেন। এই কাজে তিনিও নিজেকে সম্পূর্ণ ভাবে মেলে ধরেছিলেন। যা উদ্বুদ্ধ করেছিল সেই সময়ের আরও কিছু সহৃদয় মানুষকে। বরানগরের বিখ্যাত শশীপদ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি মা-মেয়ের অনুপ্রেরণায় এইরকম একটি আশ্রম তৈরি করেছিলেন।
সামাজিক সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতেও সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন স্বর্ণকুমারী। ১৮৮৯ ও ১৮৯০ সালে পণ্ডিতা রামাবাই, ও কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনিও জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনে যোগ দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রেও তিনি আরও কয়েকজন মহিলার সঙ্গে একটি অগ্রগামী পথের পথ প্রদর্শক। কারণ তাঁরাই ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের অধিবেশনে প্রকাশ্যে অংশগ্রহণকারী প্রথম তিন মহিলা সদস্য।
স্বর্ণকুমারী দেবী জীবনটাকে শুধু জড়িয়ে রাখেননি সংসার, সন্তান পালন আর সূচীকর্মের সীমানায়। নিজেকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন সাহিত্যে, সমাজ সংস্কার ও সেবা এবং রাজনীতিতেও। এর জন্যে তাই আবারও উল্লেখ করতে হয় তাঁর স্বামীর সহাস্য সোৎসাহ সমর্থন। সমাজ বন্ধনের ফাঁসে এই কাজের জন্য তাঁকে বিদ্রোহিনী হতে হয়নি। তার ফলে এবং নিজের প্রতিভাতেই পল্লবিত ও প্রতিভাত হয়েছেন তিনি। ফলস্বরূপ নারী জাগরণের আলো জ্বেলে ১৯২৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’-এ সম্মানিত হন স্বর্ণকুমারী। ১৯২৯ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতির শিরোপাতেও ভূষিত হয়েছিলেন তিনি।